মোংলা পৌর নেতৃত্বে জনাব আব্দুল বাতেন, জনাব শেখ আব্দুল হাই, জনাব শেখ আব্দুস সালাম ও জনাব মোল্লা আব্দুল জলিল হয়ে জনাব জুলফিকার আলী।
ধানের শীষ আর লাঙল প্রতীকে এই পাঁচ জন মেয়রের কেটে গেছে মোংলা পৌর মেয়র পদের প্রায় চার দশক।
এর ফলে দেশের দ্বিতীয় সমূদ্র বন্দর মোংলাকে কেন্দ্র করে ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত মোংলা পৌরসভার ইতিহাসের প্রায় পুরোটা সময়ে পৌর মেয়র পদটি নৌকা প্রতীকের জন্য অধরাই রয়ে গেছে।
আগামীকাল ১৬ জানুয়ারী শনিবার অনুষ্ঠিতব্য পৌর নির্বাচনে মেয়র পদটি তাই আওয়ামীলীগের নৌকা প্রতীকের জন্য এক চরম কাঙ্খিত ভোটযুদ্ধ। নৌকার পক্ষে এ যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, মোংলা পৌর আওয়ামীলীগের সভাপতি আব্দুর রহমান।
ধানের শীষের প্রার্থী টানা দশ বছর ধরে মেয়র পদে থাকা বর্তমান মেয়র জুলফিকার আলী।
রাজনীতি সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ মহল বলছে, টানা এক যুগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকে অভুতপূর্ব বহুমুখী উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে মোংলাকে তিলোত্তমা করে তোলার পর পৌর মেয়র পদটিতে নৌকার তকমা যদি এবারও না বসে তবে, স্থানীয় আওয়ামী লীগকে এর জবাবদিহি করতে হতে পারে দলীয় হাই কমাণ্ডের কাছে।
এবারের নির্বাচনে মোংলা পৌরসভার মোট ভোটার সাড়ে ৩১ হাজার প্রায়। এর মধ্যে নারী ভোটার প্রায় ১৪ হাজার সাড়ে আট শত। মোট ভোটকেন্দ্র ১২টি। সীমানা জটিলতার মামলাজনিত কারণে প্রায় এক দশক আগে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ পৌর নির্বাচনে এখানে ভোটার ছিল প্রায় ২৬ হাজার। জয় পরাজয় নির্ধারিত হয়েছিলো হাজার বারো’শ ভোটের ব্যবধানে।
বন্দর কেন্দ্রিকতার কারণে ঐতিহাসিকভাবে মোংলা পৌরসভায় বহিরাগত শ্রমিকদের বসতি আধিক্য। এখানে রাজনৈতিকভাবে বিএনপি ও জামায়াতের মতাদর্শের আধিক্যও অনেক আগে থেকে। বহিরাগত এই শ্রমিক জনগোষ্ঠী প্রধানত চারটি আঞ্চলিকতায় বিভক্ত। এর মধ্যে রয়েছে প্রায় সমান শক্তি সম্পন্ন চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিকতা, তুলনামূলক কম শক্তিসম্পন্ন বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলা উপজেলা ভিত্তিক আঞ্চলিকতা এবং তুলনামূলক দুর্বল স্থানীয় আঞ্চলিকতা (রামপাল-মোংলা)। আঞ্চলিকতার বৃহত্তর ঐক্যে কখনও কখনও মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলা বরিশালের সাথে যুতবদ্ধ। বন্দরের ইতিহাসে স্থানীয় সরকার, সংসদ নির্বাচন বা প্রতি বছরের বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন নির্বাচনে এই সমীকরণ দৃশ্যমান হয়েছে।
বলা হয়ে থাকে, আঞ্চলিকতার এই বন্ধন এখানে এতটাই ধারালো যে, বাইরে থেকে আসা এসব মানুষদের দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্ম এখন জন্মসূত্রে মোংলাবাসী হলেও তারা এখনও মোংলা নয় বরং পূর্বপুরুষের দেশ-বাড়িকেই নিজের বাড়ি মনে করেন।
ফলে সব ধরণের নির্বাচনে আঞ্চলিকতার এই বিবেচনা মাথায় রেখেই প্রার্থীদের মাঠে নামতে হয়।
বিএনপি প্রার্থী জুলফিকার বরিশালের আঞ্চলিকতার বলয়ের মানুষ। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী আব্দুর রহমান সবচে দুর্বল স্থানীয় আঞ্চলিকতার (রামপাল-মোংলা) প্রতিনিধি। নির্বাচন জিততে প্রতিকের এই লড়াইকে আঞ্চলিকতার অহংকারের উর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে আওয়ামী লীগকে।
কাউন্সিলর ভোটে আঞ্চলিকতার পাশাপাশি একাধিক প্রার্থী থাকায় বিএনপির তুলনায় পিছিয়ে থাকতে পারেন আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন প্রার্থী। কাউন্সিলর পদে দলীয় সমর্থন দেয়া নিয়েও কর্মীদের মধ্যে আছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। তবে নেতারা বলছেন, তাদের মেয়র প্রার্থীর উপর এ সবের কোন প্রভাব শেষ পর্যন্ত থাকবে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিচ্ছন্ন ইমেজের কারণে গত দশ বছরে ভোটার হওয়া তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমানের জন্য বড় শক্তি হতে পারে।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, বিএনপির প্রার্থী হলেও স্থানীয় বিএনপিকে পুরোপুরি পাশে পাচ্ছেন না জুলফিকার। কারণ গত এক দশকে বিএনপির মেয়র হয়েও আওয়ামী লীগের সান্নিধ্যে থাকতে সচেষ্ট থাকায় বিএনপি নেতা-কর্মীরা জুলফিকারকে পাশে পাননি। অন্যদিকে বাগেরহাট জেলা বিএনপির বর্তমান অভ্যন্তরীণ গ্রুপিংয়ে জুলফিকার দলীয় নেতৃত্বের বাইরে থাকা সালাম গ্রুপের নেতা হিসেবে পরিচিত।
তাছাড়া দলীয় অনেক কর্মীর অভিযোগ, বিগত সময়ে জুলফিকার বাগেরহাট-৩ সংসদীয় আসনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে নিজ দলীয় প্রার্থীর বদলে সব সময় চার দলীয় জোটের শরিক জামায়াতের প্রার্থীকে প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট ছিলেন। ফলে বিএনপি নেতা কর্মীদের ক্ষোভ রয়েছে।
আওয়ামীলীগ দলীয় কর্মীরা বলছেন, জুলফিকার দুই দফা মেয়র থাকাকালে প্রচুর অবৈধ অর্থের মালিক হয়েছেন এবং এখন তিনি সেই টাকা ছিটিয়ে নির্বাচন প্রভাবিত করে বিজয় অর্জনের চেষ্টা করছেন।দু’দলের কর্মীদের এই সব অভিযোগ সত্য হলে এ প্রশ্ন উঠবে যে, জুলফিকারের সান্নিধ্যে থেকে যারা সুবিধা নিয়েছেন তাদের রাজনৈতিক পরিচয় কি! ভোট জিততে আওয়ামী লীগকে এসব ভোটারদের দিকে জোরালোভাবে নজর দিতে হতে পারে।
অনেক বিএনপি কর্মী বলছেন, দলের কর্মীরা কোথায়? আমরা আশা করছি, কাউন্সিলর প্রার্থীরা ভোটার নিয়ে আসবেন। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে দলের সাংগঠনিক সক্ষমতা এখন এতটাই দুর্বল যে, প্রতিটি ভোটবুথে জুলফিকারের এজেন্ট না দিতে পারলে অবাক হবার কিছু নেই।এখন শুধু রাত পোহাবার অপেক্ষা।
ভোটযুদ্ধে বিজয়ী হবে কে? নৌকা না ধানের শীষ?