এসে গেলো ২০২১। নতুন বছরের শুভেচ্ছা সবার জন্যে। আজ ২০২০ সালের শেষ দিন। সময়ের বৃক্ষ থেকে আরও একটি পত্র ঝরে যাবে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই যবনিকা পতন হবে ২০২০ সালের। শুরু হবে নতুন বছর ২০২২-এর। পৃথিবীর ও বৃহত্তর মানব জীবনের পথ পরিক্রমায় ৩৬৫ দিন নিশ্চিতভাবে পরমাণুসম ক্ষুদ্র, একটি দেশ বা সমাজের সার্বিক বিবর্তনেও একটি বছর তেমন কিছু নয়, একজন ব্যক্তি মানুষের পুরো জীবন বলয়েও হয়তো একটি বছরের সামগ্রিক গুরুত্ব তেমন একটা বড় নয়, তবু প্রতিটি বছরই তার নিজস্ব তাৎপর্যে ভাস্বর যেমন পুরো পৃথিবীর জন্যে, তেমনি একটি দেশ বা সমাজের জন্য এবং সেই সঙ্গে একজন ব্যক্তি মানুষের জন্যে।
এই যে ১৯৬৯ সাল। মানুষ প্রথম চাঁদে পা রাখল- ইতিহাস সৃষ্টি হয়ে গেল সারা পৃথিবী আর মানব সভ্যতার জন্যে। আর কোনও বছর এই অভূতপূর্ব অর্জনের ওপরে দাবী রাখতে পারবে না- ওটা শুধুমাত্র ১৯৬৯-এর। তেমনি ১৯৮৯- বার্লিন দেয়ালের পতন। পূর্ব আর পশ্চিম জার্মানি মিলে অখণ্ড জার্মানি হয়ে গেল। অন্য কোনও বছর চিহ্নিত হবে না এ অভাবিত ঘটনার জন্য- ওটা ১৯৮৯-এর। তেমনি প্রতিটি ব্যক্তি মানুষের জীবনেও কোনও কোনও বছর হিরন্ময় স্মৃতি হয়ে থাকে- সুখের কারণে অথবা ধূসর পর্দা হয়ে থাকে- ‘পাতার নীচে, ছাতার মতো’ পরম ব্যপ্ত দু:খময় স্মৃতির কারণে।
প্রায়শই বহু মানুষকে বছরের শেষে বলতে শুনি, “হায়, আরও একটা বছর ঝরে গেল জীবন থেকে”- উক্তির সঙ্গে বেরিয়ে আসে বুকভাঙ্গা দীর্ঘশ্বাস। কেউ কেউ আবার এমনও বলেন, “মৃত্যুর দিকে আরও এক পা এগুলাম”। এ সব মানুষের জন্যে চলে যাওয়া বছর একটি ক্ষয়। আমার জন্যে শেষ হয়ে যাওয়া বছর একটি প্রাপ্তি।
আমি ভাবি- “জীবন ভারী সুন্দর। ইস, ভাগ্যিস, বিগত বছরটা পেয়েছিলাম জীবনে। তা নাহলে এত সব নতুন মানুষের দেখা পেতাম কি আমার জীবনে, নতুন করে জানা হতো কি পুরোনো মানুষদের, যেতে পারতাম কি নতুন নতুন জায়গায়, জানতে পারতাম কি যা ছিল অজানা? কতটা দিয়ে গেল আমাকে পুরোনো বছরটা!”
শেষ হয়ে এলো ২০২০। পৃথিবীতে কত বদল হয়েছে এ বছরে, ঘটেছে কত পরিবর্তন নানান দেশে, নানান সমাজে। ঐ সব পরিবর্তন নিয়ে অনেকের মতো ভাবি, ব্যাখ্যা খুঁজি, জানি যে এসবের প্রভাব আমার জীবনেও পড়বে। কিন্তু বাইরের বৃহত্তর পৃথিবীর পরিবর্তনে ততটা আন্দোলিত হই না, যতটা হই আমার নিজস্ব পৃথিবীর বদলে।
এর কারণ হয়তো নানাবিধ- বাইরের পৃথিবীর পরিবর্তন অনেক সময়েই নৈর্ব্যক্তিক দূরের জিনিস বলে মনে হয়, আমার পৃথিবীর বদলগুলো আমার ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে বাস্তব বিষয় বলে মনে হয়; বাইরের পৃথিবীর ঘটনাগুলো বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে অনুধাবন করতে পারি, আমার পৃথিবীর জিনিসগুলো হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পারি। তাই যে কোনও বছরকে আমি মূলত: দেখি আমার পৃথিবীর আরশিতে।
কি নিয়ে আমার পৃথিবী? আমার অতি প্রিয়জনেরা, আমার কাজ, আমার পারিপার্শ্বিকতা- এই নিয়েই তো আমার পৃথিবী। আমার পৃথিবী আমাকে ধারণ করে আছে এবং আমিও আমার পৃথিবীকে ধারণ করে আছি। তাই আমার পৃথিবী আমার ধর্মও বটে, কারণ যা আমাকে ধারণ করে আছে আর আমি যা ধারণ করে আছি, তাই তো আমার ধর্ম।
২০২০ সালে যৌথভাবে জীবনের একটা নতুন অধ্যায় শুরু করেছি শামীম আর আমি। সেই যূথবদ্ধতার অংশ আমাদের দু’জনের পুত্র-কন্যাবৃন্দ, জামাতারা এবং দৌহিত্রীদ্বয়। সবাইকে নিয়েই আমাদের সম্প্রসারিত পরিবার। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তারা নানান জায়গায়- লন্ডন, ঢাকা, নাইরোবী ও মাস্ট্রিক্টে। কথা হয় তাদের সঙ্গে থোকে-থোকে, খোঁজ নেয় তারা আমাদের এই কোভিডকালে, দেখ-ভালও করে অবিশ্যি। মাঝে মধ্যে আমরা সবাই সংযুক্ত হই নবতর তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে। এই যেমন- কাল ১ জানুয়ারী আমরা সবাই কথা বলবো।
কোভিড প্রকোপের আগে এ বছরের প্রথম দিকটাতে ঢাকায় ছিলাম। বইমেলায় গিয়েছি, বাংলা একাডেমীতে একুশের ভাষণ দিয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ কত প্রতিষ্ঠানে লোকবক্তৃতা, উন্মুক্ত বক্তৃতা করেছি। নানান পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়েছি, নানান টেলিভিশন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছি। নমিত হই এসব সুযোগের জন্যে।
কত পরিচিতজনের সঙ্গে দেখা হয়েছে এবং কত তরুণ এসে পরিচিত হয়েছে আমার সঙ্গে। কি যে ভালো লেগেছে তাদের দেখে। বড় উদ্দীপ্ত হয়েছি, যখন তারা বলেছে- আমার বলা, আমার লেখা তাদের অনুপ্রাণিত করেছে। আপ্লুত হয়েছি তাদের কথায়।
এ বছর বরিশাল আর সিলেট গিয়েছি। দু’জায়গাতেই অসংখ্য অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছি, দেদার বলেছি। বরিশালে দু’যুগ পরে গিয়েছিলাম আমার মহাবিদ্যালয় বিএম কলেজে এবং ছ’দশক পরে অশ্বিনীকুমার টাউনহলে। শ্রদ্ধাভাজন ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমেদ নিয়ে গিয়েছিল সিলেটে- পল্লী কর্ম-সহায়ক সংস্থার কর্মকাণ্ড দেখাতে। সেও এক হিরণ্ময় প্রাপ্তি বটে।
ঢাকা ছাড়ার আগে শান্তিনিকেতন গিয়েছিলাম বেড়াতে। কেমন করে যে তিনটে দিন কেটে গেল টেরই পাইনি। একটি তীর্থস্থান ভ্রমণের পরে নিজেকে পবিত্র মনে হয়েছিল।
তারপর বিশ্বকে আচ্ছন্ন করে ফেললো কোভিডের মহামারী। দৈহিকভাবে গৃহবন্দী হয়ে পড়লাম বটে, কিন্তু মানসিক দিক দিয়ে একটি নতুন দিগন্ত খুলে গেলো। ব্যস্ততা বেড়ে গেলো তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে সাক্ষাৎকার আর আলোচনা অনুষ্ঠানের, দেশে-বিদেশে। এই তো ডিসেম্বর মাসটা কেটে গেলো বিজয়ফুলের ওপরে নানান অনুষ্ঠান করে- এ কর্মসূচীর আন্তর্জাতিক দূত হিসেবে।
তবে ২০২০-এর সবটাই তো আনন্দের আর প্রাপ্তির নয়। সেখানে বেদনার বা হারানোর পাল্লাটিও তো কম ভারী নয়। এ বছর হারিয়েছি বেশ ক’জন প্রিয়মানুষ, সতীর্থবন্ধু ও চেনাজন। কোভিডও তো ছিনিয়ে নিয়েছে বহুজনকে। তাঁদের স্মরণ করি পরম মমতায়। মনে পড়ে যায় সেইসব স্বজন-প্রিয়জনদের যাঁরা অনেক আগেই চলে গেছেন আমাদের জীবন থেকে।
বেদনার জায়গা রয়েছে অন্যত্রও। কতদিন মুখোমুখি দেখি না কত প্রিয়মানুষকে, আড্ডা দিতে পারি না বান্ধবদের সঙ্গে, স্বাভাবিক নির্ভয়তায় যেতে পারি না যেথায় খুশী হেথায়। বড় কষ্ট লাগে যখন মনে পড়ে যে- বছর ঘুরে গেলো, কিন্তু জড়িয়ে ধরতে পারিনি কন্যাদ্বয়কে, কফির পেয়ালা হাতে তর্কে নামতে পারিনি জামাতাদ্বয়ের সঙ্গে, খেলায় বসতে পারিনি দৌহিত্রীর সঙ্গে। তবু জানি, একদিন এ অমানিশা শেষ হবে- ‘আবার জমবে মেলা বটতলা-হাটতলাতে’।
২০২০-এ কোনও জীবনকে আমি ছুঁতে পেরেছি কি না জানি না, কিন্তু বহু মানুষের শ্রদ্ধা, মমতা, শুভকামনা আমার জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে। অবয়ব পত্রেই তো তার স্বাক্ষর মেলে। তার বাইরে আমার অতি প্রিয়জনেরা আমার সব সীমাবদ্ধতা, দুর্বলতা, অক্ষমতা সত্ত্বেও আমাকে নি:শর্তভাবে ভালো বেসেছেন, মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন, ক্ষমা করেছেন আমার সব অপূর্ণতাকে।
সবার কাছে ঋণ আমার অনেক। কিন্তু কোনও কোনও ঋণ মানুষকে রিক্ত করে না, তাকে সমৃদ্ধ করে। তাই ঋণ শোধ করার করার কথা ভাবি না, কারণ কোনও কোনও ঋণ শুধবার নয়, আর সব ঋণ শোধ করাও যায় না এক জীবনে। ২০২১ কে বলতে ইচ্ছে হয়, ‘যা পেয়েছি, তাও থাক, যা পাইনি তাও, যা কখনও চাইনি, তাই মোরে দাও’। জয়তু: ২০২০ এবং সুস্বাগতম ২০২১।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয়তু শেখ হাসিনা
লেখকঃ ইঞ্জি. শাহনেওয়াজ খান মিলন, সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংসদ ছাত্র ফেডারেশন, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ